ছোটবেলায় দেখা মীনা কার্টুনের একটা পর্ব ছিল এরকম — মীনা ও তার বাবা দোকানদারের কাছ থেকে ঋনস্বরূপ ৮০০ টাকা নিতে গেলে দোকানদার চুক্তিপত্রে ইচ্ছা করেই ১৮০০ টাকা লিখে অক্ষরজ্ঞানহীন মীনার বাবার কাছ থেকে টিপসই নেয়। তবে বুদ্ধিমতী এবং লেখাপড়া জানা মেয়ে মীনা লেখাটি পড়ে এবং বাবাকে দোকানদারের ইচ্ছাকৃত এই “ভুল” এর থেকে বাঁচায় (লিঙ্ক)।

তথ্য-প্রযুক্তির এ-যুগের দোকানদাররা “তথ্যের” দোকান খুলে বসেছে। ইন্টারনেট ব্যাবহারে যে বিষয়টি আমরা সবচেয়ে বেশী উপেক্ষা করি তা হচ্ছে এর “টার্মস এন্ড কন্ডিশন”। প্রযুক্তি ব্যাবসায়ীরাও এটা খুব ভালো ভাবে জানে এবং এর সুবিধা তারা সবসময়ই সচেতনভাবে নেয়। এমনকি জুকারবার্গ মার্কিন কংগ্রেসের সামনেও পাবলিকলি তা স্বীকার করেছে (স্বীকারোক্তি)।

এখন চিন্তা করে দেখুন আপনি কি শর্তে তাদের সার্ভিস ব্যাবহার করছেন তা আপনি নিজে জানছেন কি? মীনার বাবার মত অশিক্ষিত না হয়েও “প্রযুক্তি জ্ঞান” এবং সচেতনতার অভাবে এই প্রযুক্তি দোকানীরা নিয়ে যাচ্ছে আমাদের সর্বস্ব। এ ব্যাপারে আমি নিজেও অসচেতন ছিলাম। আগে “টার্মস এন্ড কন্ডিশন” কিংবা “প্রাইভেসি পলেসি” পড়তাম না। কিন্তু নিজে প্রযুক্তি অঙ্গিনার মানুষ হয়ে এগুলো না পড়ে “I Agree” বাটনে ক্লিক করাটা একসময় ওই মীনার বাবার মত কিছু না জেনেই টিপ-সই দেয়ার মত মনে হলো। এটাই ইগ্নোরেন্স। সচেতন হলাম।

আইনের দুর্বলতা

বর্তমান সময়ে সরকার নিয়ন্ত্রনের চাবি বেনীয়া বা ব্যাবসায়ী গোত্রের কাছে। ২০১৭ তে টাইম ম্যাগাজিনের রিপোর্ট অনুযায়ী, ৮২% সম্পদের মালিক ১০% লোক (পড়ুন) যারা ব্যাবসায়ী। নীতিনির্ধারনে এরা যা বলে তাই-ই হয়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে বছরের পরে বছর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বা Gun Control করার সর্বস্তরের সামাজিক দাবি সত্ত্বেও অধিকাংশ রাজনীতিবিদ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবসায়ীদের থেকে বিপুল পরিমান ফান্ড পান বলে রাজনীতিবিদদের এসব ব্যাবসায়ীদের কথাই শুনতে হচ্ছে এবং নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়ন করছেন না। যার ফলাফল ২০১৮ সালের প্রায় প্রতিদিন গড়ে একটি করে mass shooting বা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবহারে গনহত্যার মত ঘটনা সেখানে ঘটছে। এ বছর প্রথম ৬ মাসেই সেখানে প্রায় ৬,৫০০ লোক Gun Violance-এ নিহত হয়েছে যা 9/11-এর টুইন-টাওয়ারে জঙ্গি হামলায় নিহতের দ্বিগুনের বেশী (লিঙ্ক)। অথচ, এ ব্যাপারে আঈন প্রণয়নে সরকারের কোনো ধরণের কোনো উদ্যোগ বা পরিকল্পনা নেই। অতএব, বোঝাই যাচ্ছে ব্যাবসায়ী চক্রের হাত কত শক্ত।

ফেসবুক প্রায় ১৫ বছর ধরে আছে। ফেসবুক ব্যাবহারের ফলে কি পরমান সামাজিক অবক্ষয় এবং মানসিক অসুস্থতা হচ্ছে এবং হবে সে ব্যাপারে প্রায় এক দশক আগে থেকেই বিজ্ঞানীরা সচেতন করে আসছেন। তবে রাজনীতিবিদরা নড়ে-চড়ে বসল যখন তাদের নিজেদের স্বার্থে আঘাত আসতে শুরু করলো। এর আগে ফেসবুকের কারণে আত্মহত্যা, সাইবার বুলিং থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যায় তারা যখন চুপ ছিল, তারাই এখন সরব হয়ে উঠেছে গত কিছু বছরে ব্রেক্সিট (ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা), ট্রাম্পের জয় এবং তাদের নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্য ব্যাবহারের মাধ্যমে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ, রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমি হতে বিতারন সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থে আঘাত আসার পরে।

অতএব, যদি মনে করে থাকেন যে এসব প্রযুক্তি মাফিয়ারা কিংবা সরকার আমাদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে নিজেরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করবে, ধারণাটি ভুল। আমাদের ভালোটা, আমাদের নিজেদের মাথা খাটিয়েই বুঝে নিতে হবে। আর সেটি করতে হবে, চিন্তা শক্তি কেড়ে নেয়ার আগেই।

শেষ কথা

পবিত্র কোরআনে মদের ব্যাপারে বলতে গিয়ে আল্লাহ বলছেন,

“লোকজন মদ ও জুয়া সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞেস করছে। বলো, ‘দুটোই গুরুতর ক্ষতিকারক। ওতে কিছু কিছু উপকারও আছে। তবে উপকারের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ অনেক অনেক বেশি।’ (বাকারা ২১৯)”

আয়াতটি নিয়ে চিন্তা করতে করতেই মনে হলো – ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও এই মদ/জুয়ার মতই। মানুষকে আসক্ত করে তোলে। একটা সময় ফেসবুক ব্যাবহার বন্ধ/কন্ট্রোল করতে চাইলেও মানুষ তা আর পারে না। উল্লেখ্য, ফেসবুক মানুষকে আসক্ত রাখতে লাস ভেগাসের ক্যাসিনো বা জুয়াঘরগুলোতে মানুষকে আসক্ত করে তোলার টেকনিকগুলো সফলতার সাথে ব্যাবহার করে আসছে; তারা নিয়োগ দেয় সেখানকার আসক্তি বিশেষজ্ঞদের (লিঙ্ক)। কোরআন এর আয়াতটি থেকেই বলতে চাই, ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগের যে ভালো দিক নেই তা নয়। তবে এর ভালো দিকের চেয়ে ব্যাক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাস্ট্রীয় এবং পুরো পৃথিবীর মানুষের জন্য সামগ্রিকভাবে এর ক্ষতির পরিমাণ অনেক… অনেক বেশি।

তাই আসুন, সচেতন হই। ফেসবুক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার বন্ধ করি। ইন্টারনেট ব্যাবহারের ক্ষেত্রে নিজে জানি যে কি ব্যাবহার করছি। নিজে না বুঝলে মীনার মত বুঝদার কারো সাহায্য নেই বোঝার জন্য। তবে অন্ধের মত অর্থলোভী দোকানদারের কাছে যেন আমরা নিজেদের না বিকিয়ে দেই। বিকিয়ে দিলে কখন আমরা ট্রাম্পের মত কাউকে নির্বাচিত করবো, কিংবা রোহিঙ্গাদের মত নিজেদের ঘড়ছাড়া হয়ে যাবো তা আমরা নিজেরাও টের পাবো না। নিজেদের ব্যাক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে পিছিয়ে পরা এবং অশান্তি তো আছেই।

[“ভার্চুয়াল ভাইরাসের” উপরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রদানকৃত বক্তব্য হতে সংকলিত – পর্ব ১]

Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
2

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *