রূপপূরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। এই কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরে পারমাণবিক জ্বালানির যে তেজস্ক্রিয় উচ্ছিষ্ট তৈরী হবে তা রাশিয়া নিয়ে যাবে। কিন্তু তারা এটা নিয়ে আসলে কি করবে? 
 
বিশেষ কিছুই করবে না… তারা অস্থায়ীভাবে এই উচ্ছিষ্ট একটি জায়গায় ডাম্প করে রাখবে। কারণ, তেজস্ক্রিয় উচ্ছিষ্ট বা নিউক্লিয়ার ওয়েস্টের ফেলে রাখার স্থায়ী কোন জায়গা/প্রক্রিয়া নেই। এর মূল কারণ কিন্তু জায়গার অভাব না। কিংবা এটাও কারণ না যে আমরা জানি না যে তেজস্ক্রিয়তাকে কিভাবে আটকে রাখতে হবে। এর মূল কারণ আসলে আমরা জানি না ভবিষ্যতের মানুষের সাথে কিভাবে কথা বলতে হবে। 

 

ভবিষ্যতের মানুষের সাথে কেন কথা বলা দরকার? 

ধরা যাক, পুরো পৃথিবী একমত হয়ে একটা নির্দিষ্ট স্থানে “স্থায়ীভাবে” সব নিউক্লিয়ার ওয়েস্ট ফেলার জন্য একমত হলো (এরকম স্থায়ী ফ্যাসিলিটি ফিনল্যান্ডে আছেও- Onkalo spent nuclear fuel repository)। সেখানে সেটা ফেলে জায়গাটি সিলগালা করে বন্ধ করে দেয়া হলো। সাথে ঝুলিয়ে দেয়া হলো বিশাল এক “প্রবেশ নিষেধ” বা “বিপদজনক” সাইন। তাতেই কি শেষ?

“স্থায়ীভাবে” কেনঃ অনেকেই জানেন যে, তেজস্ক্রিয়তা হাজার থেকে কয়েক লক্ষ বছর পর্যন্ত বিকিরিত হতে পারে এবং মৃত্যুর কারণ হতে পারে। অতএব, এই তেজস্ক্রিয় উচ্ছিষ্টকে শুধু নিরাপদে ডাম্প করে রাখলেই হলো না, হাজার/লক্ষ বছর ধরে সেই জায়গাটিতে কেউ যেন প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর এখানেই সবচেয়ে বড় বাঁধা। আর মানুষের কৌতূহলী মনই এই সমস্যার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। 

চিন্তা করে দেখুন হাজার বছর আগের বিভিন্ন জাতির ধ্বংসাবশেষ নিয়ে আমাদের কত গবেষণা, হাজার বছের আগের যেটা কবর, সেই পিরামিডকে ঘিরে আমাদের কত কৌতূহল, কত পরীক্ষা নিরিক্ষা। কোথাও গিয়ে কোনো এক্সপ্লোরার অসুস্থ বা মারা গেলে সেখানের প্রতি আগ্রহ তো আরও বেড়ে যায়… তাই মানুষের কৌতূহল থেকে নিরাপত্তা দেয়ার সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে এই নিউক্লিয়ার ডাম্পিং প্লেসের। 

 
ISO radiation warning sign

তেজস্ক্রিয়তার বিপদ বোঝাতে প্রস্তাবিত বিপদ সংকেত 
(সূত্রঃWikipedia)

Curse written on an Egyptian tomb

প্রাচীন মিশরের একটি পাতাল গুপ্ত ঘর থেকে প্রাপ্ত অভিশাপ এবং সতর্কতাবার্তা সংবলিত স্লেট।
ভবিষ্যতের মানুষেদের কাছেও কি আমাদের সতর্কবার্তা নিছক সেকেলে অভিশাপ মনে হবে?
(সূত্রঃWikimedia)

 
ভবিষ্যতের মানুষের সাথে কথা বলার চ্যালেঞ্জটা কোথায় সেটা বোঝার জন্য এই বড় প্রব্লেমটাকে একটু ভেঙে ফেলা যেতে পারে-

১. কি এবং কতটুকু বলবো?

কি বললে তাদের কাছে বিপদের বার্তা সঠিকভাবে পৌঁছানো যাবে? কতটুকু বললে তাদেরকে তেজস্ক্রিয়তা এবং এর ক্ষতিকারক প্রভাব বোঝানো যাবে (এক প্যারাগ্রাফ? এক লাইন? কয়েক পৃষ্ঠা? নাকি বইসম কিছু)? হতে পারে এমন কিছু ঘটলো ভবিষ্যতের মানুষ জানে না যে “তেজষ্ক্রিয়তা কি” বা “এর এর প্রভাব কি”? আবার উল্টোটিও তো হতে পারে… তারা হয়তো সে সময়ে তেজস্ক্রিয়তার আরও স্মার্ট  সমাধান বের করে ফেলেছে?

২. কিভাবে বলবো?

চিন্তা করে দেখুন পাঁচ বা দশ হাজার বছর আগের কোন ভাষায় কি এখন কেউ কথা বলে? কেউ যদি এখন আপনার সাথে সংস্কৃত ভাষায় কিছু বলা শুরু করে তাহলে কি আপনি কতটুকু বুঝবেন? 

ভাষা একটি পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি। ভবিষ্যতে ইংরেজি ভাষাও যে টিকে থাকবে তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? বিজ্ঞানীরা অবশ্য আপাতত একটা জিনিস চিন্তা করে রেখেছেন। সেটা হচ্ছে জাতিসংঘের অফিসিয়াল ৬ টি (ইংরেজি, আরবি, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, চাইনিজ এবং রাশিয়ান) ভাষায় একই সাবধান বার্তা লিখে রাখা। এই আশায় যে হয়তো কোনো একটি ভাষা বা তার পরিবর্তিত রূপ টিকে থাকবে। বার্তার সাথে সাথে বিপদজনক সংকেতও ব্যবহার করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

কি হবে সেই বার্তা কিংবা সংকেত তা নিয়ে ১৯৯৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি সুদূর ভবিষ্যতের মানুষের কাছে বিপদবার্তা পৌঁছানোর উপরে প্রায় ৩৫০ পাতার একটা গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করে [১]। যেখানে নিম্নোক্ত বিপদবার্তাটি প্রস্তাব করা হয় (হুবহু দিলাম) – 

 

nuclear warning text to future
 

তবে উপরোক্ত বিপদবার্তাটি পড়ার পরে আমার মনে হয়েছে – এটা দেখলে যে কারও আগ্রহ অন্তত আরও দ্বিগুন বেড়ে যেতে পারে। বড়ই কৌতুহলৌদ্দীপক বার্তা…

এটি নিয়ে চিন্তা করতে করতে মনে হলো, ভাষা যদি সমস্যাই হয়, তবে হাজার বছর পরে কোরআন কিভাবে টিকে থাকবে !? শুধু তাই নয়, ১৪০০ বছর আগের আরবি আর এখনকার আরবি ভাষাও তো এক হবার কথা না!

উত্তর খুঁজতে খুঁজতে জানতে পারলাম, আরবি ভাষাও নবীজী (সাঃ) এর সময় থেকে এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তবে শব্দগুলো তার কন্সেপচুয়াল এবং সে সময়কার কন্টেক্সচুয়াল অর্থসহ সংরক্ষন করা আছে (তবে এখানেও অনেক গবেষণার সুযোগ আছে)। ভাষাবিজ্ঞানে এটি করা হয় বিশেষ এক প্রক্রিয়ায় – যা লেক্সিকোগ্রাফি নামে পরিচিত। ব্যক্তিগতভাবে বছর চারেক আগে আমার গবেষণা ছিল – বাংলা ভাষার একটি শব্দের সাথে ইংরেজী ভাষার একটি শব্দ কন্সেপচুয়ালি কিভাবে ম্যাপ করা যায় তা নিয়ে। তাই এ ব্যাপারে কিছু ধারণা আছে। যাই হোক…

এখানেই শেষ করবো। কারণ ভবিষ্যতের মানুষদের সাথে কিভাবে যোগাযোগ করতে হবে তা এখনও আমরা জানি না। বিজ্ঞানে যে কত ইন্টারেস্টিং প্রব্লেম আছে তার একটা ছোট্ট উদাহরণ এটি। শিক্ষার্থী জীবনে “এইটা শিখে আমার জীবনে কি লাভ হবে?” এইটা মনে হয় নি এরকম মানুষ খুব কমই আছে মনে হয়। অথচ পারমাণবিক গবেষণাতেও ভাষাবিজ্ঞান থেকে শুরু করে প্রত্নতত্ব কতকিছু কাজে লাগছে! আর গবেষণায় যখন বহুমুখী জ্ঞান একত্র করা হয়, তখনই বিজ্ঞান এগিয়ে যায়।

 
 
[১] Trauth, K.M., Hora, S.C., & Guzowski, R.V. (1993) Expert judgment on markers to deter inadvertent human intrusion into the Waste Isolation Pilot Plant. United States. http://doi.org/10.2172/10117359 

 

Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *