এবারের গ্রীষ্মে বেশ কয়েক জায়গায় ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে। মাসখানেক আগে ২ সপ্তাহের সফরে কানাডার মন্ট্রিয়াল আর আমেরিকার নিউ ইয়র্ক ঘুড়ে আসলাম। আজকে একটু সময় পেয়ে মন্ট্রিয়ালের সফর সম্পর্কে লিখছি।
অনেকে জেনে থাকবেন কানাডায় ইংরেজ এবং ফরাসী দুই ঔপনিবেশিকেরই উপনিবেশ ছিল। কানাডার পূর্বাঞ্চলিও ক্যুবেক এবং মন্ট্রিয়াল এরিয়াতে ফরাসী প্রভাব বেশী ছিল। এখানের মূল ভাষাও ফ্রেঞ্চ। শহরের একটা অংশে এখনও ইউরোপিয়ান ভাইব আছে।
চারিদিকে নদী ঘেরা মন্ট্রিয়াল বেশ বড় শহর। ২ দিনে পুরোটা দেখার সুযোগ না হলেও শহরের আদি অংশ বা “ওল্ড মন্ট্রিয়াল”, ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির প্রত্নতাত্মিক জাদুঘর, বোটানিক্যাল গার্ডেনসহ বেশ ভালো একটা অংশ ঘুড়ে দেখার সুযোগ হয়েছে। আর সেটা করেছি দিনে প্রায় ৭০ কি.মি. সাইকেলে চালিয়ে!
মন্ট্রিয়ালে থাকা বন্ধুসম এক ছোটভাইকে সাথে নিয়ে ২৪ ঘন্টার জন্যে ৫ ডলারের বিনিময়ে সাইকেল ভাড়া নিয়েছিলাম। অনেক বড় শহরেই এরকম সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সাইকেল মাউন্টিং/ডিস্মাউন্টিং প্লেস থাকে। তাই সুবিধামত প্রয়োজনে লম্বা দূরত্বের জন্য বাস/ট্রেন ব্যাবহার করে নেমে আবার সাইকেল ব্যাবহার করা যায়। ট্রাভেলারদের জন্য এটা ভালো কারন সিটি ট্যুরটা খুব ভালো হয় এবং শহরের জীবন যাত্রা অনেক কাছ থেকে দেখা যায়।
নটর ডেম বেসিলিকা
মন্ট্রিয়ালে দেখা সবকিছুর মধ্যে নটর ডেম বেসিলিকা বা নটর ডেম চার্চ আলাদা হয়ে থাকবে। বলে নেয়া ভালো, এই নটর ডেম আর ফ্রান্সের নটর ডেম ক্যাথেড্রিয়ালের দু’টো আলাদা চার্চ। অনেকে গত এপ্রিলে ফ্রান্সের নটর ডেম ক্যাথিড্রাল আগুনে পুড়ে যাওয়ার খবর শুনেছেন। একই সঙ্গে দুঃখজনক এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে মন্ট্রিয়ালের এই নটর ডেম চার্চটির একটি অংশও বছর চল্লিশেক আগে আগুনে পুড়ে গিয়েছিল।
মন্ট্রিয়ালের নটর ডেম প্রায় ৩৫০ বছরের পুরোনো একটি ক্যাথলিক চার্চ। ইউরোপিয়ানরা ১৬শ শতকের মাঝে যখন মন্ট্রিয়াল আসে তখন খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারের জন্য এটি তৈরী করে যা মন্ট্রিয়াল এবং ক্যুবেক এলাকার প্রথম চার্চ ছিল। এরপরে একশ বছরে এখানে খ্রিষ্ট ধর্মানুসারীর সংখ্যা এতই বৃদ্ধি পায় যে – ভেতরে জায়গার অভাবে চার্চের নিয়মিত প্রার্থনায় সমবেত মানুষ চার্চের চারিদিকে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতো । উল্লেখ্য, জায়গাটা কানাডা যেখানে মাইনাস ২০-৪০ ডিগ্রী বরফের মধ্যে তাঁরা এটি করতো।
পরবর্তীতে ১৮শ শতকের প্রথম দিকে চার্চ কর্তৃপক্ষ এটি বড় এবং নতুন করে করার সিদ্ধান্ত নেয়। নতুন চার্চটিই গত ২০০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অসম্ভব সুন্দর এবং জাকজমকপূর্ন চার্চের প্রতিটি নকশা। পুরো জায়গাটির সামগ্রিক এবং ইন্ডিডিভিজুয়াল ডিজাইনে সুগভীর চিন্তা, পরিকল্পনা এবং ধর্মীয় অনেক চেতনার সুনিপূন প্রকাশ দেখলে সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়।
চার্চটির আর্কিটেকচারাল বিবরন দিতে গেলে লেখা অনেক বেশী লম্বা হয়ে যাবে। তাই এটির যিনি স্থপতি তাঁর সম্পর্কে একটু বলে শেষ করি –
নটর ডেম চার্চটি একটি রোমান ক্যাথলিক চার্চ। ১৮শ শতকে বানানো নতুন চার্চটির নকশা করেছিলেন জেমস ও’ডনেল নামের এক আইরিশ-আমেরিকান স্থপতি। তিনি ছিলেন একজন এঙ্গেলিকান। এঙ্গেলিকানিসম খ্রিষ্ট ধর্মের একটি চর্চার ধারা যা প্রটেস্টান চর্চার একটি উপধারা। তৎকালীন ক্যাথলিক কট্টরপন্থীতা আর ধর্মীয় গোত্রভেদের কারনে সে সময়ে একজন এঙ্গেলিকান একটি ক্যাথলিক চার্চ বানাবে এটা ছিল একরকম অকল্পনীয় ব্যাপার।
তবে, জেমস তাঁর সামর্থের পুরোটা ঢেলে দিয়ে, ধর্মীয় ভেদ পাশে রেখেই ক্যাথলিক অনুসারীদের জন্য এক অসম্ভব সুন্দর প্রার্থনালয় করে দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যেন একজন প্রার্থনাকারী এই উপাসনালয়ে এসে যেন পরমাত্মার সাথে সংযুক্ত হতে পারে, হোক সে প্রার্থনাকারীরা ক্যাথলিক, খ্রিষ্টের অনুসারীই তো।
পুনর্নিমান শেষে এটি ছিল নর্থ আমেরিকার সর্ববৃহৎ চার্চ। জেমস চেয়েছিলেন যেন তাঁর সমাধি এই চার্চের ক্রিপ্ট বা চার্চের ভূগর্ভস্থ সমাধিকক্ষে দেয়া হয়। চেয়েছিলেন জীবনের সেরা সৃষ্টি কর্মের নিচেই সমাধিস্থ হতে। তবে যেহেতু তিনি এঙ্গেলিকান ছিলেন, ক্যাথলিক কর্তৃপক্ষ তাঁর এই অনুরোধ রাখতে অস্বীকৃতি জানায়।
নটর ডেম চার্চ তৈরী করতে করতেই একসময় জেমস শারীরিকভাবে অসুস্থ হতে থাকেন এবং মৃত্যুবরণ করেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মৃত্যুবরণের আগে মৃত্যুশয্যায় তিনি ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহন করেন। আর নটর ডেম বেসিলিকার মাটির নিচে একজনেরই কবর, যেটি জেমস ও’ডনেলের!