শিশুরা কি স্রষ্টায় বিশ্বাস করে? নাকি গড, ভগবান, ঈশ্বর, আল্লাহ এই ধারনাগুলো শুধু বড়দেরই? এটা বোঝার জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষনা নতুন নয়। গত এক শতকে বিভিন্ন গবেষনায় এ নিয়ে উঠে এসেছে খুবই মজার এবং অবাক করে দেয়ার মত তথ্য।  জাস্টিন ব্যারেট (পিএইচডি) রচিত “বর্ন বিলিভারস” বইয়ে এই বিষয়ের উপরেই সমস্ত কিছু ধাপে ধাপে বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তের উপরে ভিত্তি করে বর্ননা করা হয়েছে।

Read English version of this article here

ইসলাম ধর্মে “ফিতরা” বা “প্রাকৃতিক আস্তিকতা” বলে একটি ধারনা আছে যা কোরআনেই বর্নিত। এই ধারনা মতে, আল্লাহ আমাদের আমাদের রুহ/আত্মায় তাঁর প্রতি বিশ্বাস গেঁথে দিয়েছেন। মানুষের স্রষ্টা-বিশ্বাস তাই প্রবৃত্তিগতই। চাপিয়ে দেয়া কিছু নয়। হিন্দু থেকে শুরু করে অন্যান্য ধর্মেও রয়েছে এমন বিশ্বাস। কিন্তু এ তো ধর্মের কথা। বিজ্ঞান কি বলে?

শিশুর আস্তিকতা’র সূচনা

ডেভেলপমেন্টাল সাইকোলজির গবেষণা থেকে দেখা যায় যে শিশুরা খুব অল্প বয়স থেকেই জীব, জড়, দৃশ্যমান বস্তু, অদৃশ্য অস্তিত্ব সনাক্ত করতে পারে। শুধু তাই নয়, যেকোনো ঘটনার পেছনের কার্যকারন জানার ব্যাপারেও তাদের আগ্রহ ও সক্ষমতা রয়েছে। অতএব স্রষ্টা বলে যদি কেউ/কিছু আদৌ থেকে থাকে শিশুরা সেটি বুঝতে পারার কথা। বিভিন্ন গবেষনা থেকে দেখা গেছে শিশুরা স্রষ্টার এই ধারনা এত সহজে গ্রহন করে যেন তারা আগে থেকেই এর জন্য প্রি-প্রোগ্রামড হয়ে আছে। তাদের কাছে স্রষ্টা এক পরিচিত অস্তিত্ব। কখনো কখনো বড়দের চেয়েও তারা সুনিপুনভাবে স্রষ্টার অতিপ্রাকৃত বৈশিষ্ট্য যেমন – স্থান-কালের উর্ধবতা, সবকিছুর নিয়ন্ত্রক, তাঁর বৈশিষ্ট্যের অসীমতা ইত্যাদি গ্রহন করে নিতে পারে।

কিন্তু কিভাবে তারা স্রষ্টার সাথে এত পরিচিত? সবচেয়ে সহজ উত্তর হচ্ছে অভিভাবকের কাছ থেকে! কিন্তু আদৌ কি তাই?  “ইনডক্ট্রিনেশন হাইপথেসিস” বা অভিভাবকের কাছ থেকে পাওয়া দীক্ষামাত্র – এই  মতবাদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো যুক্তি বইয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে।

যেমন – অভিভাবকেরা যদি শিশুদের এই ব্রেইনওয়াশ না করতো তাহলে কি পৃথিবী থেকে ধর্মীয় ধারনা বিলুপ্ত হয়ে যেত?  হিসাবে দেখা যায় যে, স্রষ্টায় অবিশ্বাস বা নাস্তিকতাটাই যদি শিশুদের মধ্যে সহজাত হতো তাহলে একজন নাস্তিকের সন্তান নাস্তিকই হতো (অথচ নাস্তিকের সন্তান আস্তিক এমন উদাহরন অনেক)। এরকম চললে ৬ প্রজন্মের (আনুমানিক ২০০ বছর) ভেতরে পৃথিবীতে ধার্মিক মানুষ অবশিষ্ট থাকবে মাত্র ৫%। কিন্তু কোথায়!? হিন্দু ধর্ম হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে। ইহুদী, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ইসলাম ধর্মের বয়সও কয়েক হাজার বছর। অতএব, নিশ্চিতভাবেই শুধুমাত্র “অভিভাবকের কাছ থেকে পাওয়া দীক্ষা” না। অন্যকিছুও এখানে কাজ করছে।

তাছাড়া বড়রা যা বলবে তা যদি শিশুরা এত সহজেই গ্রহন করে নিত, তবে আমাদের অভিভাবকের জীবনটা বোধহয় আরো অনেক সহজ হতো। অভিভাবকরা অধিকাংশ সময়েই চায় যে তার বাচ্চাটা একটু কথা শুনুক। না শুনলেও, একটু শোনার চেষ্টা করুক। উলটো বৈজ্ঞানিক ফলাফলে দেখা যায় যে – শিশুদের উপরে কোনো ধারনা জোর করে চাপিয়ে দিতে গেলে তা আরো হীতে-বিপরীত ফল বয়ে আনে।

অভিভাবকের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিৎ

এসময়ের অন্যতম নাস্তিক ডকিন্স এবং হিচেন্স শিশুদেরকে স্রষ্টার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়াকে শিশু (যৌন) নির্যাতনের সাথে তুলনা করেছেন। অথচ অনেকগুলো গবেষনালব্ধ ফল থেকে এটি পরিষ্কার যে – যে পরিবারে ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা যত বেশি সেই পরিবারের সন্তানদের মানসিক, আত্মিক, সামাজিক,  শারীরিক বিকাশ তত চমৎকার হয়। অন্যদিকে শিশু নির্যাতনের নেতিবাচক প্রভাব গবেষনা থেকে পরিষ্কার। এবং এই দুইয়ের মধ্যে কোনো বৈজ্ঞানিক যোগসূত্রের কোনো অস্তিত্বই নেই। তাই কোনো ধরনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছাড়া ডকিন্স এবং হিচেন্সের বিভিন্ন বক্তৃতা, লেখায় এধরনের দাবী দায়িত্বজ্ঞানহীন ও বিজ্ঞানের জন্যই বিপদজনক। নিঃসন্দেহে, শিশুদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা দায়িত্বশীল অভিভাবকের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, নাস্তিকতা শিশুদের মধ্যে সহজাত কিনা সে নিয়েও বইয়ে ব্যখ্যা করা হয়েছে। এমনকি আপনার শিশুকে একজন সফল নাস্তিক হিসেবে গড়ে তুলতে কি করতে হবে সেই পরামর্শও দেয়া হয়েছে বইয়ের দশম অধ্যায়ে!

সঠিক অভিভাবকত্ব

গত একশ বছরে শিশু মনবিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষনা থেকে এটি একরকম পরিষ্কার যে অভিভাবকের প্রভাব ছাড়া  শিশুদের সহজাত স্রষ্টা-বিশ্বাস প্রবনতা একটি অকাট্য সত্য। শিশুদের আস্তিকতা সহজাত হলেও একে ফাইন টিউন করতে প্রয়োজন হয় সঠিক দিক নির্দেশনার। বইয়ে উল্লেখিত একটি ঘটনা – একটি শিশুকে জিজ্ঞাসা করা হলো, যীশু সম্পর্কে না জানলেও সে কিভাবে যীশুকে অনুসরন করে? তার উত্তর, “আমি শুধু বাবাকে দেখি। বাবা জানে যে যীশু কিভাবে জীবন-যাপন করতো। সে ওইভাবে কাজ করে। আমি তার মত করে কাজ করি… ব্যাস!”

শিশুরা প্রাথমিকভাবে তার অভিভাবকের মধ্যে তার আদর্শ খুঁজে পায়। বাবা/মা’র মত হতে চায়। তাই প্রাকৃতিকভাবে শিশুরা সহজাতভাবে আস্তিক হলেও, অভিভাবকের সুস্পষ্ট সঠিক দিকনির্দেশনা গুরুত্বপূর্ন। যেমনঃ শিশুরা প্রাকৃতিকভাবে ক্ষুধা লাগলে বাছ-বিচার ছাড়াই সহজাতভাবে যেকোনো কিছু মুখে ঢুকিয়ে চাবানো/গলধকরন শুরু করবে। কিন্তু সঠিক এবং পুষ্টিকর খাবার চেনানোর জন্য তার দিকনির্দেশনার প্রয়োজন। এ ব্যপারে অভিভাবকদের কিরকম ভূমিকা পালন করা উচিৎ তা নিয়ে শেষ দুই অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

বিশ্বাসের অধিকার

বইয়ের শেষে অভিভাবকদের উদ্দ্যেশ্য করে লেখক বলেছেন – যারা তাদের শিশুকে সঠিক ধর্মিয় শিক্ষা দিতে চান তাদের এটা জানা জরুরী যে – অভিভাবক হিসেবে আপনার দায়িত্ব হচ্ছে আপনি যা সত্য, কল্যাণকর হিসেবে বিশ্বাস করেছেন, জেনেছেন তা নিজে পালন করা এবং আপনার সন্তানকে সেই আলোকে শিক্ষা দেয়া। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত এটা তার সিদ্ধান্ত – সে স্রষ্টায় বিশ্বাস করবে, কি করবে না।

শিশুরা স্রষ্টা-বিশ্বাসী হিসেবেই জন্ম নেয়। কিন্তু তার মৃত্যু বিশ্বাসী হিসেবে হবে কিনা সেটা সম্পুর্নই তার এবং তার স্রষ্টার মধ্যের ব্যাপার।


Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *